তবে ধ্বংসই হোক সুন্দরবন!

ঘাড়ের ওপর বিশ্ব উষ্ণায়নের নিঃশ্বাস। মানুষের লোভে বার বার ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ। বাদাবন কেটে তৈরি হয়েছে মাছের ঘের। জঙ্গল সাফ করে গড়ে উঠছে বসতি। বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে চলছে চাষাবাদ। 

অথচ কতবার যে ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বনটি দেশকে রক্ষা করেছে; তার কোনো হিসাব নেই। যেমনটা হয়েছে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণী কিংবা বুলবুলের সময়ে। 

শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্তৃত সুপার সাইক্লোন আমফানের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। থাই শব্দ ‘আমফান’ মানে আকাশ। বঙ্গোপোসাগরের এ ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির আগে থেকেই আলোচনায়। এর গতি প্রকৃতির ওপর সময়ে সময়ে চোখ রাখছিলেন অনেকে। প্রযুক্তির সাহায্যে ধরা আমফানের বিভিন্ন ছবিও ভাইরাল হয়। তবে দুটি বিশেষ ম্যাপ ছিল বেশ অদ্ভুত- সাগরের দানব আমফান ডাঙায় উঠে যেন রীতিমতো দু’ভাগে বিভক্ত! সৌজন্যে সেই সুন্দরবন। শক্তি হারানোর কারণে বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। এরপরও সামান্য সময়ের তাণ্ডবে ছত্রাকার অবস্থা। ধ্বংসের চিহ্ন চারদিকে। প্রকৃতির এই বর্ম মুখ ফিরিয়ে নিলে তাণ্ডব যে কোন পর্যায়ে যেত, ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়!

২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘বাংলাদেশে ঝড় থেকে সুরক্ষায় ম্যানগ্রোভ বনের ভূমিকা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ১৮৭৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৪৮টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৯৬৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে হানা দেয় ২০টি। সবকটিই সরাসরি উপকূল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে; যার বেশিরভাগই ছিল খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও বাগেরহাট অঞ্চল। তবে ঝড়গুলোর গতি কমানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে সুন্দরবন। বিশাল বনের ভেতর দিয়ে ঘূর্ণিঝড় যাওয়ার সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪ থেকে সাড়ে ১৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত কমেছে। বিশেষ করে ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত হানা সিডরের বাতাস ও জলোচ্ছ্বাসের গতি সুন্দরবনের কারণে অর্ধেকে নেমে আসে বলে জানায় এ গবেষণা। 

বাতাসের গতি কিংবা ঢেউয়ের তীব্রতা সবদিক থেকেই বিরল এক ঘূর্ণিঝড় ছিল আমফান। একসাথে এত বিশাল উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তৃতি এর আগে দেখেনি কেউ। আঘাত হানার পর দীর্ঘ সময় শক্তি ধরে রাখারও নতুন নজির দেখাল সুপার সাইক্লোনটি। তবে এর গতি ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার থাকলেও নিজের বুক পেতে তা ১০০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয় সুন্দরবন। 

এ বিষয়ে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির জানান, ঘূর্ণিঝড়টি যদি বরিশালমুখী হতো তাহলে দেশের জন্য বয়ে আনত বড় এক দুর্যোগ; কিন্তু সুন্দরবন দিয়ে অতিক্রম করায় আমফানের তাণ্ডব কিছুটা কম হয়েছে। বরাবরের মতো এবারও উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করতে বুক চিতিয়ে লড়াই করল বনটি। অবশ্য দেশের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে পারলেও ভেঙে গেছে তার ১২ হাজার ৩৫৮টি ডানা (গাছ)। 

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, বনটিকে তার মতো করে থাকতে দিলে পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। গেল দেড়শ বছরে ৭৫টি প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েও বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন। নিকট অতীতেও সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুলের ক্ষত কাটিয়ে উঠেছিল।

উদ্বেগের রঙ বদল

আমফানের কয়েক দিন পর থেকেই সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছের পাতা সবুজ থেকে ক্রমে বিবর্ণ হয়ে যায়। একপর্যায়ে তা হলুদ হয়ে শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। ঝরেও যাচ্ছে ছোট ছোট কিছু গাছের পাতা। এ আবার নতুন কোনো বিপদ নয় তো? 

উদ্ভিদ বিষারদরা অবশ্য বলছেন, আমফানে বৃষ্টির চেয়ে ঝড়ের দাপট ছিল অনেক বেশি। তাই হয়তো প্রবল ঝড়ে সামুদ্রিক নোনাপানির ঝাপটায় গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। যদি ঝড়ের সাথে ভারি বৃষ্টি হতো, তা হলে এমনটা হতো না।

তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয়প্রধান অধ্যাপক কৃষ্ণেন্দু আচার্য বলেন, ‘ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ নোনা পানিতেই বেড়ে ওঠে। সেই গাছ কেন হলুদ হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। একটি কারণ হতে পারে, প্রবল ঝড়ে ওইসব গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও গাছে সবুজ পাতা বিবর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ; কিন্তু যা-ই হোক, ম্যানগ্রোভের গাছের পাতা হলুদ কিংবা বিবর্ণ হলে তা ভয়ংকর। এ বিষয়ে যতদ্রুত সম্ভব বিশদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।’

সুন্দর হারাচ্ছে সুন্দরী

দীর্ঘ সময় ধরে জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। 

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। দূষিত হচ্ছে মাটি ও বাতাস। ক্রমাগত কমছে উপকূলের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত সুন্দরীগাছ। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিকুলেও।’ 

এই গবেষক আরো বলেন, ‘সুন্দরী গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় সমুদ্রের ঝড় তাতে বাধা পায় এবং সেটি দুর্বল হয়ে স্থলভাবে আছড়ে পড়ে। বিশাল ক্ষতি থেকে রক্ষা পাই আমরা; কিন্তু আশঙ্কাজনকহারে বনের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বাড়ায় মারা যাচ্ছে অনেক সুন্দরী গাছ। নোনা পানিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে এ গাছের বীজ। প্রকৃতির বৈরিতায় কমছে উচ্চতাও। এতে গাছগুলোকে ঘিরে প্রাণিকুলের যে বাস্তুতন্ত্র, তাতেও পরিবর্তনের হাওয়া। এটা চলতে থাকলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি বেড়ে যাবে। এর প্রমাণ মেলে সামান্য ঝড়েই বনের ক্ষত দেখে। সুন্দরবনে আগেও গাছ ভাঙত, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। মূলত সুন্দরী গাছের উচ্চতা কমে যাওয়ায় ঝড়ো হাওয়া সরাসরি গিয়ে লাগছে বনে। প্রাণ হারাচ্ছে প্রাণীও।’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘সুন্দরবন নিজের ক্ষতি করে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি আগলে রাখে। অথচ এটিকে রক্ষায় গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। এখনো সচেতন হলে হয়তো খানিকটা প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচানো সম্ভব; কিন্তু এ সময়টাও চলে গেলে তখন আর বিপদের শেষ থাকবে না। তাই আমাদের অতিআপন সুন্দরবনকে বাঁচাতে আটকাতে হবে ম্যানগ্রোভ নিধন। বন্ধ করতে হবে বনের আশপাশে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম।’ 

তবে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনকে নিয়ে তেমন গবেষণা করার সুযোগ মেলে না জানিয়ে এ গবেষক বলেন, ‘এ অঞ্চলের জলে-জঙ্গলে কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে, তা নিয়ে অবিলম্বে সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। সেই সাথে স্থানীয়দের হাতে বন ধ্বংসেও নিয়ন্ত্রণ জরুরি। তবে এটি করতে হলে, তাদের বিকল্প কাজ দিতে হবে আগে। যারা জীবিকার জন্য গাছ কাটেন, কিংবা মাছ ধরেন, তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন- সুন্দরবন হচ্ছে মায়ের মতো। অন্য কোনো কাজ পেলে এ বনের ক্ষতি হয়, এমন কিছুই তারা করবেন না।’

উন্নয়নে ধ্বংসের বার্তা

পশ্চিমবঙ্গের দিঘা সমুদ্রসৈকতে ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও ছিল ঝাউগাছের সারি আর বালিয়াড়ি। প্রায় একাই ঠেকিয়ে দিত সাগর থেকে উঠে আসা দানব যত ঘূর্ণিঝড়! অথচ পরবর্তীকালে বেশি পর্যটক টানতে সৌন্দর্যায়নের নামে রঙ-বেরঙের বাহারি কংক্রিটের ইট বসিয়ে তৈরি হয় মেরিন ড্রাইভ। বদলে যায় গ্রাম্য দিঘার সেই পরিবেশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই শহুরে চেহারার হাত ধরেই দিঘার বুকে নেমে এসেছে বিপদের চোরা স্রোত। বস্তুত কোনোরকম ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার মতো প্রাকৃতিক পরিবেশই আর নেই তার। উল্টো যেকোনো দিন নিজেই বিলীন হবে সমুদ্রগর্ভে। আমাদের দেশেও এবার কথিত ‘উন্নয়নের’ ছোঁয়া লাগছে সুন্দরী, কেওড়া, গর্জন, গরানদের পোক্ত শেকড়ে মাটি আঁকড়ে রাখা সুন্দরবনেও।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অবশ্য বলেন, ‘উন্নয়ন বলতে বোঝায় বিদ্যমান সম্পদ ও সক্ষমতা বাড়ানোকে। যেখানে জীবনকে আরো সহজ, আরামদায়ক ও নিরাপদ, জ্ঞানবিদ্যা, যোগাযোগ ও বিনোদনের জগৎ প্রসারিত হয়। যদি দেখা যায় সম্পদ ও সক্ষমতা আরো বিপর্যস্ত হচ্ছে; জীবন হচ্ছে আরো কঠিন, অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ- তাহলে কি আর তাকে উন্নয়ন বলা যায়? রামপালসহ মানুষ ও প্রকৃতিবিধ্বংসী প্রকল্পগুলোই তার দৃষ্টান্ত। গায়ের জোরে যতই ঢোল পেটানো হোক, দেশকে যা বিপন্ন করে, তা কখনোই উন্নয়ন নয়।’

আইনবন্দি লাল ফিতায়

খোদ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে আদালতে উপস্থাপিত এক নথিতে সুন্দরবনের আশপাশে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০টি শিল্পকারখানা স্থাপনের বৈধ অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। প্রকৃত পরিস্থিতি আরো নাজুক।

অথচ ১৯৯৯ সালে বনটির চারপাশের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বা ইসিএ ঘোষণা করা হয়। আর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ইসিএতে যে কোনো ধরনের কারখানা নিষিদ্ধ। তবে কার স্বার্থে আইনের হাতে আজ প্লাস্টার?

উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি শাহেদ শফিক বলেন, ‘একসময় সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার উপকূলজুড়েই ছিল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। নানা অত্যাচারে সিংহভাগই আজ বিলীন। যুদ্ধ করে টিকে থাকা সুন্দরবনকে ঘিরেও গড়ে উঠছে একের পর এক কলকারখানা, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাছাড়া পর্যটকদের ফেলে যাওয়া খাবারের প্যাকেট, পানির বোতলসহ নানা রকম প্লাস্টিক বর্জ্য জোয়ারের পানিতে ভেসে শ্বাসমূলে আটকা পড়ছে। এতে মারা যাচ্ছে ম্যানগ্রোভ। কোনো কোনো উপকূলে অবৈধভাবে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়ায় পরিকল্পিতভাবেও বন উজাড়ে মেতেছে ভূমিদস্যুরা।’ 

আক্ষেপ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘যে বন আমাদের বাঁচায়, তাকেও তো আমাদেরই বাঁচাতে হবে; কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই ভুলে যাই তার সব উপকার!’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //